728x90 AdSpace

  • Latest News

    হযরত আনছার মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না-উনাদের ফযীলত মুবারক

    ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম-উনাদের ফযীলত
    আরবী ছাহাবী শব্দের বহুবচন হচ্ছে ছাহাবা, ছাহাবী অর্থ হচ্ছে সঙ্গী, সাথী । ছাহিব অর্থও সঙ্গী বা সাথী, যার বহুবচন আছহাব । এর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে যিনি ঈমানের সাথে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাক্ষাত লাভ করেছেন এবং ঈমানের সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, উনাকেই ছাহাবী বলা হয় । ছাহাবী মুহাজির ও আনছার, পুরুষ ও মহিলা উভয় প্রকার হতে পারেন। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে সার্বিক ভাবে সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে । কুরআন শরীফে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন :-
    رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوْا عَنْهُمْ –
    (অর্থ: আল্লাহ পাক তিনি উনাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং উনারাও আল্লাহ পাক উনার প্রতি সন্তুষ্ট )। (সুরা তওবা/১০০) . কালাম পাকে খালিক, মালিক, রব্ব, মহান আল্লাহ পাক তিনি পৃথকভাবে আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের প্রশংসা করেছেন, যেমন :-
    وَ يُؤْثِرُوْنَ عَلَى أنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ –
    (অর্থ: আর উনারা অর্থাৎ আনছারগণ নিজেদের উপরে মুহাজিরগণ উনাদেরকে প্রাধান্য দেন, যদিও উনাদের অভাব অত্যন্ত প্রকট । (সুরা হাশর/৯). সুবহানাল্লাহ !
    সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক করেন :-
    أصحابى كاالنجوم بأيهم إقتديتم إهتديتم –
    (অর্থ : আমার ছাহাবীগণ আকাশের নক্ষত্ররাজীর ন্যায়, উনাদের যে কেউকে তোমরা অনুসরণ করবে, তোমরা হিদায়েত প্রাপ্ত হবে). অন্য হাদীছ শরীফে শুধু আনছার ছাহাবীগণ সম্পর্কে হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন :-
    عن حضرت أبى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من أحبَّ الأنصارَأحبَّهُ الله و من أبغض الأنصارَ أبغضهُ الله (بخارى و ترمذى شريف) –
    (অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত । তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন : যে ব্যক্তি আনছারগণ উনাদেরকে ভালবাসে, আল্লাহ পাক তিনি তাকে ভালবাসেন। আর যে ব্যক্তি আনছারগণ উনাদেরকে অপছন্দ করে, আল্লাহ পাক তিনি তাকে অপছন্দ করেন (বুখারী ও তিরমিজী শরীফ)।
    মুহাজির ও আনছার ছাহাবী
    মক্কা শরীফ থেকে এবং অন্যান্য স্থান থেকে হিজরত করে যে সব ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনারা মদীনা শরীফে বসবাস করেন উনারা মুহাজির ছাহাবী ও ছাহাবিয়া হিসাবে পরিচিত এবং যাঁরা মদীনা শরীফের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন উনারা আনছার ছাহাবী ও ছাহাবিয়া হিসাবে পরিচিত হন। মুহাজির অর্থ হিজরতকারী এবং আনছার অর্থ সাহায্যকারী । যেহেতু মক্কা শরীফ থেকে আগত এবং অন্যান্য বহিরাগত মুহাজির ছাহাবীগণ উনাদের মদীনা শরীফে জীবন যাপন, খাওয়া পরা এবং বাসস্থান ইত্যাদির ব্যাপারে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দাগণ সার্বিকভাবে সাহায্য করেছেন, সেজন্য উনাদের নামকরণ হয় আনছার । সাধারণভাবে সমস্ত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের বেমেছাল ফাযায়েল ফযীলত রয়েছে।

    আনছার-মুহাজির ভাতৃত্বের সম্পর্ক
    মুহাজির ছাহাবীগণ মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফে হিজরত কালে সম্পূর্ণ নি:স্ব ও রিক্ত হস্তে এসেছিলেন, যদিও উনাদের মধ্যে অনেক ধনী ব্যক্তিও ছিলেন। উনারা মুশরিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে নিজেদের জান নিয়ে অতি সংগোপনে কোনরূপে মদীনা শরীফ চলে এসেছিলেন । মক্কা শরীফ থেকে কোন কিছুই নিয়ে আসতে পারেন নি । এতদসত্বেও মুহাজির ছাহাবীগণ উনারা অন্যের দান দক্ষিণায় চলতে আগ্রহী ছিলেন না । উনারা ছিলেন কর্মঠ ও পরিশ্রমী । যদিও আ্নছার ছাহাবীগণ মুহাজির ছাহাবীগণ উনাদেরকে মনে প্রাণে মেহমান হিসাবে বরণ করে নিয়েছিলেন, তবু মুহাজির ছাহাবীগণের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে দেয়া ছিল একান্ত প্রয়োজন । সেইজন্য হিজরতের পর পরই নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনছার ও মুহাজির ছাহাবীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক করে দিতে মনস্থ করেন। অত:পর হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার মাতা হযরত উম্মে সুলায়ম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার গৃহেই আনছার-মুহাজির ছাহাবীগণকে একত্র করে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং উনাদের মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক করে দেয়া হয় । এতদ্বারা মদীনা শরীফ উনার স্থায়ী বাসিন্দা আনছার ছাহাবীগণ উনাদেরকে মক্কা শরীফ থেকে ও অন্যান্য স্থান থেকে আগত মুহাজির ছাহাবীগণ উনাদের থাকা, খাওয়া ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেয়ার ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়া হয় । একজন মুহাজির ও একজন আনছারের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক করে দেয়ার সময় সম-মনা ও সম-গুণ সম্পন্ন লোক নির্বাচন করা হয় ।
    ভ্রাতৃত্ব বন্ধন-এর স্বরূপ এবং আনছারগণ উনাদের প্রকৃতিগত খিদমত
    মুহাজির-আনছার ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক কতটা কার্যকর হয়েছিল এবং আনছারগণ কিভাবে মুহাজিরদের মেহমানদারী ও খেদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন, এ সম্পর্কে দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে :-
    (১) বিখ্যাত ছাহাবী হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন হিজরত করে মদীনা শরীফে পদার্পন করেন, উনার সাথে আনছারী ছাহাবী হযরত সা‘দ ইবনে রাবী‘ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্‎হু-উনার ভ্রাতৃত্ব স¤পর্ক স্থাপন করে দেয়া হয় । হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্‎হু বর্ণনা করেন: আমার আনছারী ভাই হযরত সা‘দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমাকে বললেন, আনছারগণের মধ্যে আমি একজন স¤পদশালী ব্যক্তি । আমার অর্দ্ধেক স¤পদ আপনাকে প্রদান করছি ; আর আমার দুই আহলিয়ার যাকে আপনার পছন্দ হয়, তাকে আমি তালাক দিব, আপনি তাকে বিবাহ করতে পারেন । সুবহানাল্লাহ ! হযরত আবদুর রহমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্‎হু উত্তরে বললেন: এগুলির আমার কোন প্রয়োজন নেই । আল্লাহ পাক আপনার পরিবার পরিজন ও ধন স¤পদে বরকত দিন । ব্যবসা বানিজ্যের জন্য এ স্থানে কোন বাজার আছে কি ? হযরত সা‘দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন : হাঁ, নিকটেই ইয়াহুদীদের বনু কায়নুকা বাজার রয়েছে। হযরত আবদুর রহমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্‎হু পরদিন ভোর হতেই উক্ত বাজারে কিছু ঘি ও পণির নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। উনার ব্যবসার এত উন্নতি হতে লাগল যে, অল্প দিনের মধ্যেই তিনি একজন বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ীতে পরিণত হন । এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, আনছারী ছাহাবী হযরত সা’দ বিন রাবী‘ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কের যেরূপ তুলনাহীন নজীর প্রদর্শন করেছেন, মুহাজির ছাহাবী হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনি কিন্তু সে সুযোগ হুবহু গ্রহণ করেন নি । তিনি সে সময় অবিবাহিত ছিলেন । ইচ্ছা করলে তিনি আনছারী ব্যক্তির অর্দ্ধেক সম্পদ ও একজন আহলিয়া নিয়ে স্বচ্ছন্দে দিন গুজরান করতে পারতেন । কিন্তু তিনি আনছারী ব্যক্তি থেকে প্রয়োজন পরিমাণ অর্থ নিয়ে নিজে ব্যবসা শুরু করলেন । পরে যখন উনার চলার মত ব্যবস্থা হলো, তখন তিনি একজন আনছারী মহিলাকে বিবাহ করেন । এতে উভয় ছাহাবীর উন্নত মন-মানসিকতার পরিাচয় মিলে।
    (২) একদা এক ক্ষুধার্ত ব্যক্তি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট উপস্থিত হয়ে নিজের অবস্থা জ্ঞাপন করল । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজের ঘরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, শুধু পানি ছাড়া আর কিছু নেই । তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদেরকে বললেন : তোমাদের মধ্যে এ লোকটির মেহমানদারী করার মত কেউ আছে কি ? হযরত আবু ত্বলহা আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন : আমি আছি । এই বলে তিনি মেহমানকে উনার বাড়ীতে নিয়ে গেলেন । বাড়ী গিয়ে উনার আহলিয়া হযরত উম্মে সুলায়ম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, উনার সন্তানদের খাবার উপযোগী কিছু খাদ্য আছে । তখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পরামর্শ মত হযরত উম্মে সুলায়ম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে দিলেন । তারপর মেহমানকে খাবার খেতে দিয়ে কৌশলে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলেন । উনারা অবস্থাটি এমন দেখালেন যে, মেহমানের সাথে উনারাও দস্তারখানে খেতে বসেছেন। আসলে কিন্তু উনারা কিছুই খেলেন না । কিন্তু মেহমানকে এ কথা বুঝতে দিলেন না । যার ফলে মেহমান তৃপ্তির সাথে খানা খেলেন । এভাবে নিজেরা পরিবারের সকলেই অনাহারে রাত কাটালেন । সকাল বেলা তিনি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট আসলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জানালেন যে, উনার ব্যাপারে এই আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে :-
    وَ يُؤْثِرُوْنَ عَلَى اَنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ –
    (আর তারা অর্থাৎ আনছারগণ তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিরদেরকে) নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও) (৫৯:৯) এবং তাদের রাত্রের আচরণে আল্লাহ পাক খুবই সন্তুষ্ট হয়েছেন (মুসলিম শরীফ) । ছুবহানাল্লাহ !
    হযরত আনছার মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না-উনাদের ফযীলত
    আমাদের আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে হযরত আনছার মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না উনাদের ফযীলত ।
    সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হিজরতের সময় কুবা পল্লী থেকে মদীনা শরীফ-উনার মূল ভূখন্ডের দিকে তশরীফ আনয়ন করার সময়, তখন তিনি ছানিয়াতুল বিদা নামক মদীনা শরীফ উনার একটি পর্বতের নিকটবর্তী হয়ে তশরীফ এনেছিলেন। তখন মদীনা শরীফ উনার অধিবাসী আনছার পরিবারগণ উনাকে অভ্যর্থনা করে মেহমান হিসাবে নেয়ার জন্য সারিবেধে দন্ডায়মান ছিলেন। হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন: আমার উটের পথ ছেড়ে দাও, সে আদীষ্ট আছে । তখন ছোট ছোট আনছারী বালক-বালিকারা আবৃত্তি করছিলেন :-
    طلع البدر علينا – من ثنية الوداع
    وجبت شكر علينا – ما دعى لله داع
    (অর্থ: ছানিয়াতুল বিদা পর্বত-মালা থেকে আমাদের উপর উদিত হয়েছে পূর্ণিমার চাঁদ, এখন শোকর করা আমাদের উপর ওয়াজিব হয়ে গিয়েছে যে পর্যন্ত কোন আহ্বানকারী বা দোয়াকারী আল্লাহ পাক-উনাকে ডাকতে থাকবেন অর্থাৎ এই নিয়ামতের জন্য সর্বক্ষণ শোকরিয়া আদায় করা আমাদের উপর ওয়াজিব হয়ে গেছে). আসলে যদিও ছোট ছোট বালক বালিকাগণ এই পংক্তিটি আবৃত্তি করেছিলেন ইহা ছিল মদীনা শরীফ-উনার সর্ব সাধারণ আনছার স্ত্রাী-পুরুষ উনাদের মনের অব্যক্ত আকুতি এবং আকাঙ্খা । ছুবহানাল্লাহ ! নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বাহন হযরত আবু আইয়ূব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার বাড়ীর নিকটে বসে পড়েন। অত:পর হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত আবু আইয়ুব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বাড়ীতে তশরীফ আনয়ন করেন ।
    হযরত আবু আইয়ুব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং উনার আহলিয়া কিভাবে হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আপ্যয়ন ও মেহমানদারীর মাধ্যমে খিদমতের আঞ্জাম দেন, একটি ঘটনা থেকে স্পষ্ট হবে । উনার বাড়ীটি ছিল দ্বিতল । তিনি উপর তলাটি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার জন্য ছেড়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট লোক সমাগমের সুবিধার জন্য নীচ তলায় অবস্থান করা পছন্দ করেন । হযরত আবু আইয়ূব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রত্যহ দু বার করে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট খাবার সামগ্রী পাঠাতেন । তিনি উহা থেকে যা ফেরত দিতেন, হযরত আবু আইয়ূব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও উনার আহলিয়া তাই খেয়ে নিতেন। ঘটনাক্রমে একবার প্রচন্ড শীতের রাতে উপর তলায় পানির সোরাহী ভেঙ্গে গেল । পানি গড়িয়ে নীচে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিল, কারণ ফ্লোর ছিল কাঠের । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার অসুবিধা হবে এ চিন্তুায় হযরত আবু আইয়ূব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও উনার আহলিয়া ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন । গৃহে উভয়ের গায়ে দেয়ার জন্য একটি মাত্র লেপ ছিল । উনারা তাই পানির উপর ছড়িয়ে দিলেন । লেপ পানি চূষে নিল । আর প্রচন্ড শীতের সময় উনারা স্বামী স্ত্রী লেপ ছাড়া রাত কাটালেন । সুবহানাল্লাহ ! (পৌষ-মাঘ মাসে মদীনা শরীফে প্রচন্ড শীত পড়ে, যা আমাদের দেশের শীত অপেক্ষা অনেক বেশী তীব্র হয়ে থাকে)
    হযরত আবু আইয়ূব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বাড়ীটি মসজিদে নববী শরীফ উনার ঠিক দক্ষিন দিকে অবস্থিত । ১৯৮৩-৮৪ সাল পর্যন্ত ভগ্ন-প্রায় বাড়ীটির অংশবিশেষ দেখা যেত । কাঁচা ইট, পাথর ও মাটির গাথুনী দিয়ে ইহা প্রস্তুত ছিল । বর্তমান সউদী ওহাবী সরকার ইহা ভেঙ্গে সরকারী কোর্ট নির্মান করেছে । এভাবে পূর্ববর্তী অনেক স্মাৃতি চিহ্ণ সওদী ওহাবী সরকার মুছে দিয়েছে এবং এখনও মুছে দিচ্ছে ।
    আমরা কতিপয় আনছার মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না-উনাদের জীবনী মুবারক থেকে কিছু কিছু ঘটনা উল্লেখ করব, যদ্বারা উনাদের ফযীলত ও বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাবে :-
    ১. হযরত উম্মে আত্বীয়া বিনতুল হারিছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা
    উনার প্রকৃত নাম নুসায়বা, উ¤েম আতিয়া উনার উপনাম । একজন বিশিষ্ট আনছারী মহিলা ছাহাবী। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে তশরীফ আনার পর পরই আনছারী মহিলাদেরকে বাইয়াতের জন্য একটি গৃহে একত্র করেন । অত:পর সেখানে হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম উনাকে প্রেরণ করেনক। তিনি এসে দরজার অপর পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে আনছারী মহিলাগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন: আমি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতিনিধি হিসাবে আপনাদের নিকট এসেছি । আপনারা এসব কথার উপর বাইয়াত গ্রহণ করুন : আল্লাহ পাক উনার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবেন না, চুরি করবেন না, ব্যভিচার করবেন না, আপনাদের সন্তানদের হত্যা করবেন না, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিবেন না, ভাল কথা মেনে নিতে অস্বীকার করবেন না । আনছার মহিলাগণ এ সকল বিষয়ে স্বীকার করে বাইয়াত গ্রহণ করেন । উনাদের মধ্য থেকে হযরত উ¤েম আতিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা জিজ্ঞাসা করলেন : ভাল কথা অস্বীকার করার অর্থ কি ? হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম বললেন : উচ্চেস্বরে শোক করা ।
    হযরত উম্মে আতিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে খায়বরসহ সাতটি জিহাদে শরীক হন । তিনি মুজাহিদগণ উনাদের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করতেন, উনাদের জিনিষপত্রের হেফাজত করতেন এবং রুগ্ন ব্যক্তিদের সেবা শুশ্র“ষা করতেন । খায়বরের জিহাদে তিনি বিশ জন মহিলার একটি দলের সাথে জিহাদের ছোয়াব লাভের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন ।
    আহলে বায়ত শরীফ অর্থাৎ নবী পরিবারের সাথে হযরত উম্মে আতিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার গভীর সুসম্পর্ক ছিল। বিশেষত: উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার সাথে সম্পর্ক ছিল খুবই আন্তরিক। তিনি হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার জন্য হাদিয়া তোহফা প্রেরন করতেন। একদিন তিনি ছদকাস্বরূপ প্রাপ্ত একটি বকরির গোস্ত থেকে উহার কিছু গোশ্ত উ¤মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার নিকট পাঠিয়ে দেন । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ঘরে এসে কিছু খেতে চাইলে হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম তিনি বললেন : নুসাইবা কর্তৃক প্রেরিত গোশ্ত ছাড়া ঘরে আর কিছুই নেই । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করলেন : উহাই দিন, উহা যার পাওয়ার হক ছিল সে পেয়েছে (অর্থাৎ উহা তার জন্য ছদকা, আর আমাদের জন্য হাদিয়া). হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার অন্যান্য আত্মীয় স্বজন উনাদের সাথেও উনার সুস¤পর্ক ছিল ।
    হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রথমা ছাহেবযাদী হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম উনার বিছাল শরীফের পর হযরত উম্মে আতিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আরো কয়েকজন মহিলাসহ উনাকে গোছল মুবারক প্রদান করেন । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং উনাকে গোছলের নিয়ম কানুন শিক্ষা দিয়েছিলেন । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার আর এক ছাহেবযাদী হযরত উ¤েম কুলছুম আলাইহাস সালাম উনার বিছাল শরীফের পর উনাকেও হযরত উম্মে আতীয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা গোছল মুবারক প্রদান করেন । পরবর্তীতে ছাহাবী ও তাবেঈগণ উনার নিকট হতে এই নিয়ম কানুন শিক্ষা করতেন।
    খুলাফায় রাশেদীন প্রথম চার খলীফা উনাদের আমলে উনার এক পুত্র এক জিহাদে শরীক ছিলেন। ইতিমধ্যে উনার পুত্র অসুস্থ হয়ে পড়েন। সংবাদ পেয়ে হযরত উম্মে আতিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা মদীনা শরীফ থেকে বছরা রওয়ানা হন । কিন্তু উনার বছরা পৌঁছার পূর্বেই ছেলেটি ইনতিকাল করেন । ছেলের মৃত্যুর তিন দিন পর তিনি দেহে সুগন্ধি মাখেন এই বলে যে, স্বামী ব্যতীত অন্য কারো জন্য তিন দিনের অধিক শোক করা জায়েয নেই । অত:পর হযরত উম্মে আতিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বছরায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন । হিজরী ৭০ সন পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন । ধারণা করা হয় যে, এই সনেই তিনি বিছাল শরীফ লাভ করেন (সিয়ারু আলামিন নুবালা)।
    উনার নিকট থেকে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন হযরত মুহ¤মদ ইবনে সীরীন রহমতুল্লাহি আলাইহি, উনার বোন হযরত হাফছা রহমতুল্লাহি আলাইহা, হযরত আবদুল মালিক বিন উমায়র রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইসমাঈল বিন আবদির রহমান রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত আলী বিন আক্বমার রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখ, এবং আরো অনেকে । উনার বর্ণিত হাদীছ সমূহ ছিহাহ সিত্তার অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে ।
    বছরায় হযরত উম্মে আতীয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা একজন ফকীহ ছাহাবিয়া হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। উনার হাদীছ শরীফের জ্ঞান, শরীয়তের বিধান সম্পর্কে সুক্ষজ্ঞান এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নৈকট্যের কথা জানাজানি হওয়ার পর সকল শ্রেণীর মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন । যেহেতু তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দুই কন্যার গোসল মুবারক প্রদান করেছিলেন, অনেক ছাহাবী এবং হযরত মুহম্মদ ইবনে সীরীন রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাদের মত উঁচূ স্তরের ফকীহ তাবে‘ঈগণও উনার নিকট এসে মৃতের গোছল দানের নিয়ম পদ্ধতি ও অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞান লাভ করতেন (ইছাবা). সূত্র : ইছাবা, উসুদুল গাবা, সিয়ারু আলামিন নুবালা, অন্যান্য সীরত গ্রন্থাবলী
    ২. হযরত উম্মে ‘উমারা বিনতু কা‘ব বিন ‘আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা
    মদীনা শরীফের বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখার মহিলা, বিখ্যাত বদরী ছাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে কা‘ব আল-মাযিনী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার বোন (সিয়ারু আলামিন নুবালা)।
    হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার জীবনের প্রথম বড় ঘটনা এই যে, তিনি বাইয়াতুল আক্বাবায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন । ইহা ছিল আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত । এই বাইয়াতে মদীনাবাসী ৭৫ জন মুসলমান অংশ গ্রহণ করেন । তন্মধ্যে দুই জন মহিলা ছিলেন । হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ছিলেন উনাদের মধ্যে একজন । দ্বিতীয় মহিলা ছিলেন উম্মে মানী‘ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ।
    তিনি উনার স্বামী হযরত যায়দ বিন আছিম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও দুই পুত্র হযরত হাবীব ও হযরত আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা-উনাদের সঙ্গে উহুদের জিহাদে অংশ গ্রহণ করেন । মূলত: তিনি গিয়েছিলেন একটি পুরাতন মশক সঙ্গে নিয়ে যোদ্ধাদের পানি পান করানোর উদ্দেশ্যে । কিন্তু এক পর্যায়ে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন । জিহাদে তিনি চমৎকার রণকৌশলের পরিচয় দেন। (তাবাকাত, সিয়ারু আলামিন নুবালা)
    উহুদের জিহাদের এক পর্যায়ে শত্র“ বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে মুসলিম বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে যায় । মুষ্টিমেয় কয়েকজন দৃঢ়মনা মুজাহিদ নিজেদের জীবন বাজি রেখে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিরাপত্তা বিধান করছিলেন ।
    উহুদের জিহাদের বর্ণনা হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা এভাবে দিয়েছেন । তিনি বলেন : জিহাদের এক পর্যায়ে যখন মুসলমানগণ পর্যুদস্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক (সংখ্যায় দশ জন হতে পারে) ছিল । এই সংখ্যার মধ্যে আমি, আমার দুই ছেলে ও স্বামী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পাশে দাঁড়িয়ে শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করছিলাম । কোন কোন মুজাহিদ (সম্ভবত: আহত অবস্থায়) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পাশ দিয়েও চলে যাচ্ছিলেন । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন আমার হাতে কোন ঢাল নেই । তিনি এক ব্যক্তিকে দেখলেন, উনার হাতে একটি ঢাল । তিনি সেই লোকটিকে বললেন: ওহে, তুমি তোমার ঢালটি যে লড়ছে এমন কারো দিকে ছুঁড়ে দাও । সেই লোক ঢালটি ছুঁড়ে দেয় এবং আমি তা হাতে তুলে নিই । সে ঢাল দিয়েই আমি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাকে আড়াল করতে থাকি। সেদিন অশ্বারোহী যোদ্ধারা আমাদের সাথে যা করেছিল, যদি তারা আমাদের মত পদাতিক হতো, তা হলে আমরা শত্র“দের অনেক ক্ষতি করতে সক্ষম হতাম। তিনি আরো বলেন, কোন অশ্বারোহী আমাদের দিকে এগিয়ে এসে আমাকে তরবারির আঘাত করলে আমি সে আঘাত ঢাল দিয়ে ফিরিয়ে দিতাম । সে আমার কিছুই করতে সক্ষম হতো না । অত:পর যখনই সে পিছনে ফিরে যেতে উদ্যত হত, তখনই আমি তার ঘোড়ার পিছন পায়ে তরবারির কোপ বসিয়ে দিতাম । ঘোড়াটি আরোহী সহ মাটিতে পড়ে যেত। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ছেলেকে ডেকে বলতেন : ওহে উ¤েম উমারার ছেলে ! তোমার মাকে সাহায্য কর । সে ছুটে এসে আমাকে সাহায্য করত । এভাবে আমি অনেককে মৃত্যুর ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েছি । (তাবাকাত, সিয়ারু আলামিন নুবালা) সুবহানাল্লাহ !
    উহুদের জিহাদের দিন হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিলেন। হযরত দ্বামরা ইবনে সা‘ইদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দাদা উহুদের একজন যোদ্ধা, তিনি বলেছেন হযরত উম্মে ‘উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা সেদিন কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে শত্র“দের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালান । এ জিহাদে উনার দেহের তেরটি স্থান মারাত্মকভাবে আহত হয় (তাবাকাত). সুবহানাল্লাহ !
    এ সময় এক কাফিরের নিক্ষিপ্ত একটি পাথরের আঘাতে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার একটি দাঁত মুবারক ভেঙ্গে যায় । নাউজু বিল্লাহ ! পাষন্ড ইবনে কামিয়া হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাকে তাক করে তরবারির একটি কোপ মারে, কিন্তু তা ফসকে যায় । নাউজু বিল্লাহ ! মূহূর্তে হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ফিরে দাঁড়ান । তিনি নরপশু ইবনে কামিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন । কিন্তু তার সারা দেহ বর্ম আচ্ছাদিত থাকায় বিশেষ কার্যকর হলো না । সে হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনাকে তাক করে এবার একটি কোপ মারে এবং তা হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার কাঁধে লাগে । এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন । সুবহানাল্লাহ ! হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে আহত হতে দেখে উনার ছেলে হযরত আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনাকে ডেকে বললেন : তোমার মাকে দেখ, তোমার মাকে দেখ। তার ক্ষতস্থান বেন্ডেজ কর । আল্লাহ পাক-উনার হাবীব দোয়া করলেন : আয় আল্লাহ পাক ! তাদের সবাইকে জান্নাতে আমার বন্ধু করে দিন (সিয়ারু আলামিন নুবালা). সুবহানাল্লাহ ! হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন : দুনিয়ায় আমার যে কষ্ট ও বিপদ আপদ এসেছে, অত:পর তাতে আমার কোন পরোয়া নেই (তাবাকাত). সেদিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে দাঁড়িয়ে থেকে উনার ক্ষতস্থানে বেন্ডেজ বাঁধানোর ব্যবস্থা করেন । এ সময় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকজন সাহসী ছাহাবীর নাম উচ্চারণ করে বললেন : উম্মে উমারার আজকের কর্মকান্ড অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। এরপর প্রায় এক বছর যাবত উনার ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করা হয় (তাবাকাত)।
    উহুদের এই মারাত্মক আক্রমণে হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার ছেলে হযরত আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মারাত্মকভাবে আহত হন । হযরত আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন : সেদিন আমি মারাত্মকভাবে আহত হলাম । রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছিল না । তা দেখে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করলেন : তোমার আহত স্থান বেন্ডেজ কর । কিছুক্ষণ পর আমার মা অনেকগুলি বেন্ডেজ হাতে নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসেন এবং আমার আহত স্থানে বেন্ডেজ করে দেন । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন পাশেই দাঁড়ানো । বেন্ডেজ করা শেষ হলে আমার মা আমাকে বললেন : বেটা, উঠ। শত্র“ সৈন্যের গর্দান মার । নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন : ওহে উম্মে উমারা ! তুমি যতখানি সাহস ও শক্তি-সামর্থ রাখ, অন্যের মধ্যে তা কোথায় ? হযরত আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আরো বর্ণনা করেন: এ সময় যে শত্র“ সৈন্যটি আমাকে আহত করেছিল, অদূরে তাকে দেখা গেল । নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার মাকে বললেন: এ সেই ব্যক্তি যে তোমার ছেলেকে যখম করেছে । আমার মা বললেন: আমি তার মুখোমুখি হব এবং তার ঠ্যাং-এর নলা ভেঙ্গে দিব । একথা বলে তিনি তাকে আঘাত করে ফেলে দেন । তা দেখে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে দেন । তারপর তিনি বললেন : উম্মে উমারা ! তুমি বদলা নিয়েছ । তারপর আমরা দুইজনে মিলে আঘাতের পরে আঘাত করে তাকে জাহান্নামের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম । তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : উ¤েম উমারা ! সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক-উনার জন্য যিনি তোমাকে সফলকাম করেছেন (সিয়ারু আলামিন নুবালা). সুবহানাল্লাহ !
    হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উহুদের জিহাদ ছাড়াও তিনি আরো অনেক জিহাদে অংশ গ্রহণ করেন । হযরত ইবনে সা‘দ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বর্ণনা মতে তিনি উহুদ, হুদায়বিয়া, খায়বার, উমরাতুল কাযা, হুনায়ন ও ইয়ামামার জিহাদে যোগ দিয়েছিলেন ।
    নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফের পর ইয়ামামার অধিবাসী ও তাদের নেতা মুসায়লামা আল-কাজ্জাব মুরতাদ হয়ে যায় । সে নিজকে নবী দাবী করে । তার গোত্রে প্রায় চল্লিশ হাজার লোক তার জন্য যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল । তাই সে জোর জবরদস্তি দ্বারা তার নবুয়তের স্বীকৃতি আদায় করত । অস্বীকৃতি জানালে তার উপর নানাভাবে নির্যাতন চালাত । হযরত উ¤েম উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার এক ছেলে হযরত হাবীব ইবনে যায়দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ওমান থেকে মদীনা শরীফে আসার পথে মুসায়লামার হাতে বন্দী হন । মুসায়লামা উনাকে বলে : তুমি তো সাক্ষ্য দিয়ে থাক যে, হযরত মুহ¤মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ পাক-উনার রসুল । হযরত হাবীব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন : হাঁ, আমি তাই সাক্ষ্য দিয়ে থাকি । মুসায়লামা তখন বলে : না, তোমাকে এ কথা বলতে হবে যে, মুসায়লামা আল্লাহ পাক-উনার রসুল । নাউজু বিল্লাহ ! হযরত হাবীব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শক্তভাবে তার দাবী প্রত্যাখ্যান করেন । মুসায়লামা হযরত হাবীব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার একটি হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে । তারপর হযরত হাবীব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার নিকট একই স্বীকৃতি দাবী করে। তিনি পূর্বের মতই অস্বীকৃতি জানান । অত:পর পাষন্ড মুসায়লামা হযরত হাবীব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার একটি একটি করে দেহের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে । আল্লাহ পাক-উনার এই প্রিয় বান্দা জীবন দেয়া সহজ মনে করেছেন, কিন্তু বিশ্বাস থেকে চূল পরিমাণ বিচ্যূত হওয়া সমীচীন মনে করেন নি । সুবহানাল্লাহ ! এই ঘটনা হযরত উ¤েম উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার কানে পৌঁছলে তিনি মনকে শক্ত করেন এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যদি কখনও মুসলিম বাহিনী এই পাষন্ড মুসাইলামা কাজ্জাব-এর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তখন তিনিও অংশ গ্রহণ করবেন এবং আল্লাহ পাক চাইলে নিজের হাতে এই জালিমকে জাহান্নামের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিবেন । (সিয়ারু আলামিন নুবালা)
    অত:পর হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ইয়ামামার জিহাদে অংশ গ্রহণের জন্য হযরত আবু বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম-উনার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করেন । খলিফা অনুমতি দিলেন । হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার বাহিনীতে যোগ দেন । প্রচন্ড জিহাদ চলল । হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা সুযোগের অপেক্ষায় আছেন । উনার একমাত্র লক্ষ্য ঘাতক পাষন্ড মুসায়লামা আল-কাজ্জাব । এক সময় তিনি এক হাতে বর্শা ও অন্য হাতে তরবারি চালাতে চালাতে শত্র“ বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে মুসায়লামার কাছে পৌঁছে যান । এ পর্যন্ত পৌঁছতে উনার দেহের এগারটি স্থান বর্শা ও তরবারির আঘাতে আহত হয় । একটি হাত বাহু থেকে বিচ্ছিন্নও হয়ে যায় । এতেও উনার সিদ্ধান্ত টলে নি । তিনি আরো একটু এগিয়ে গেলেন । মুসায়লামাকে তাক করে তরবারির কোপ মারবেন, ঠিক এমন সময় হঠাৎ একসাথে দু’টি আঘাত মুসায়লামার উপর এসে পড়ে । আর সে কেটে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে । তিনি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে দেখেন, উনার ছেলে হযরত আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পাশে দাঁড়িয়ে । তিনি জিজ্ঞেস করলেন : তুমিই কি তাকে হত্যা করেছ ? হযরত আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জবাব দিলেন : একটি কোপ আমার এবং অন্য আঘাতটি হযরত ওয়াহসি রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার। আমি বুঝতে পারছি না কার আঘাতে সে নিহত হয়েছে । হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা দারুন উৎফুল্ল হলেন এবং তখনই সিজদায় গিয়ে শোকর আদায় করলেন । সুবহানাল্লাহ ! (ইবনে হিশাম)।
    হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার যখম ছিল খুবই মারাত্মক । একটি হাতও কাটা গিয়েছিল । এ কারণে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। সেনাপতি হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজ তত্তাবধানে উনার সেবা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন । উনার চিকিৎসায় যাতে ত্র“টি না হয় সে ব্যাপারে সর্বক্ষণ সতর্ক দৃষ্টি রাখেন । তাই তিনি সুস্থ হয়ে সারা জীবন হযরত খালিদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন । সুবহানাল্লাহ !
    হযরত উম্মে উমারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার বিছাল শরীফ কখন হয় তা সঠিক ভাবে জানা যায় নি । ইয়ামামার জিহাদের পরে কতদিন তিনি জীবিত ছিলেন তা কেউ বলতে পারেন নি ।
    সূত্র : উসুদুল গাবা, সিয়ারু আলামিন নুবালা, তাবাকাত, ইছাবা,ইবনে হিশাম, সীরত গ্রন্থাবলী
    ৩. হযরত উম্মে সুলাইম বিনতু মিলহান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা
    মদীনা শরীফের বনু নাজ্জার গোত্রের আনছার মহিলা ছাহাবী । তিনি ছিলেন হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাদিম হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মাতা।
    হযরত উম্মে সুলায়ম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা মদীনা শরীফে ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন । এজন্য উনার স্বামী মালিক ইবনে নাদ্বার রাগান্বিত হয়ে সিরিয়া চলে যায় এবং সেখানেই কাফির অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে । অত:পর নাজ্জার গোত্রীয় আবু তালহা উনাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন । তখনও আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করেন নি । হযরত উম্মে সুলাইম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন : আপনার মত লোকের বিবাহের প্রস্তাব অস্বীকার করা যায় না । কিন্তু আপনি হলেন কাফির, আর আমি একজন মুসলিম রমণী । আপনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া আমার জন্য হালাল নয় । আমি একটি প্রস্তাব দিতে পারি । তা এই যে, যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তবে তা-ই আমার মোহরানা হিসাবে গণ্য হবে অর্থাৎ মোহরাণার জন্য এর অতিরিক্ত কোন টাকা পয়সা আপনাকে দিতে হবে না। আমি আপনার নিকট ইহা ব্যতীত আর কিছুই চাইব না। অত:পর হযরত আবু তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং উনাদের বিবাহ মুবারক সংঘটিত হয়ে গেল । বিবাহে অতিরিক্ত কোন মোহরানা ধার্য হলো না। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন: অত:পর আমি হযরত উম্মে সুলায়ম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার মোহরানা অপেক্ষা মর্যাদাকর কোন মোহরানার নাম কখনও শুনি নি । সুবহানাল্লাহ !
    নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করে মদীনা শরীফে তশরীফ আনয়ন করলে হযরত উম্মে ছুলাইম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার পুত্র হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনাকে সঙ্গে নিয়ে উনার খিদমতে উপস্থিত হন এবং বলেন : আমার পুত্র আনাসকে আপনার খিদমতে পেশ করছি । আপনি তাকে কবুল করুন এবং তার জন্য দোয়া করুন । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনাকে গ্রহণ করেন এবং উনার জন্য দোয়া করলেন ।
    হযরত উম্মে সুলাইম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা অতি উৎসাহের সাথে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে কয়েকটি জিহাদে শরীক হন। হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেছেন, তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম এবং হযরত উম্মে সুলাইম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনাদেরকে মশক ভর্তী করে পানি আনতে এবং আহতদের উহা পান করাতে দেখেছেন । উহুদের জিহাদে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে কর্তব্য পালন করে গিয়েছেন । খায়বরের জিহাদেও তিনি অংশ গ্রহণ করেছিলেন ।
    হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আমার মা হযরত উম্মে সুলায়ম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার স্বামী হযরত আবু তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার পক্ষের আবু উমায়র নামে একটি শিশু পুত্র সন্তান ছিল । আবু উমায়র রোগগ্রস্ত থাকা অবস্থায় একদিন হযরত আবু তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মসজিদে নববীতে গমন করেন । এদিকে উনার এই পুত্রটি ইনতিকাল করেন । রাত্রেই তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা স¤পন্ন করা হয় । এদিকে গভীর রাত্রে কিছু মেহমান ছাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে হযরত আবু তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বাড়ী ফিরলেন । হযরত উম্মে সুলায়ম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা সকলের জন্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন । অত:পর মেহমানগণ বিদায় হলে হযরত আবু তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আহলিয়াকে অসুস্থ পুত্রের কথা জিজ্ঞাসা করলেন । হযরত উম্মে সুলাইম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন : আগের তুলনায় ভাল । অত:পর উনারা একত্রে শয়ন করলেন। শেষ রাত্রের দিকে হযরত উম্মে সুলাইম রদ্বিযাল্লাহু তায়ালা আনহা উনাকে পুত্রের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে প্রবোধ দিলেন যে, পুত্র ছিল আমাদের নিকট গচ্ছিত আল্লাহ পাক-উনার আমানত । যাঁর আমানত তিনি উহা উঠিয়ে নিয়েছেন। উহাতে আমাদের দু:খ করা ঠিক নয় । সুবহানাল্লাহ ! হযরত আবু তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়লেন এবং ছবর করলেন। সকালে হযরত আবু তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ঘটনাটি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট বর্ণনা করলে তিনি ইরশাদ মুবারক করেন : এই রাত্রটি তোমাদের উভয়ের জন্য বরকতময় ছিল। সেই রাত্রেই তিনি গর্ভবতী হন এবং এবং একটি পুত্র বিলাদত শরীফ লাভ করলে তার নাম রাখা হয় “আবদুল্লাহ”। পরবর্তীকালে তিনি একজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ হয়েছিলেন । সুবহানাল্লাহ !
    একবার উনার স্বামী হযরত আবু তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গৃহে এসে উনাকে বললেন : নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুধার্ত আছেন, কিছু খাদ্য পাঠিয়ে দিন । হযরত উম্মে সুলাইম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার পুত্র হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার মারফত কিছু রুটি একটি কাপড়ে জড়িয়ে পাঠিয়ে দিলেন । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন : তোমাকে কি আবু তালহা আমাদেরকে আহারের দাওয়াত দিতে পাঠিয়েছে ? হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন : হাঁ । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট উপস্থিত সকল ছাহাবীদের সঙ্গে নিয়ে হযরত আবু তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার গৃহে তশরীফ আনলেন । খাদ্য পরিমাণে খুব স্বল্প হওয়ায় হযরত আবু তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খুব বিচলিত হলেন । কিন্তু হযরত উ¤েম সুলাইম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা স্থির চিত্তে বললেন : আল্লাহ পাক তিনি ও উনার রসুল সবই জানেন । অত:পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গৃহে প্রবেশ করলে হযরত উ¤েম সুলাইম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা সেই কয়টি রুটি ও সামান্য কিছু তরকারী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার স¤মুখে পরিবেশন করলেন । আল্লাহ পাক তিনি এই খাদ্যে এত বরকত দিলেন যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ও উনার সঙ্গের ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনারা সকলেই তৃপ্তি সহকারে আহার করলেন। একমতে তিনি হযরত উছমান যুন্নুরাইন আলাইহিস সালাম-উনার খিলাফত আমলে বিছাল শরীফ লাভ করেন । সূত্র : তাবাকাত, ইছাবা, বুখারী শরীফ, উসুদুল গাবা
    ৪. হযরত আসমা বিনতু ইয়াযীদ ইবনিস সাকান আল-আনছারীয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা
    আনছারী ছাহাবীয়া, হযরত মু‘য়ায ইবনু জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার চাচাত বোন, উনার স্বামী হযরত সাইদ ইবনে আম্মারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু (সিয়ারু আলামিন নুবালা). নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে হিজরত করে আসার পর তিনি মুসলমান হন । তিনি আকাবার শেষ বাইয়াতে অংশ গ্রহণ করেন (হায়াতুচ্ছাহাবা). হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ পরিবেষ্টিত অবস্থায় বসে আছেন । এমন সময় হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আসলেন এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাকে সম্বোধন করে বললেন :-
    হে আল্লাহ পাক-উনার রসুল ! আমি একদল মুসলিম মহিলার পক্ষ থেকে তাদের কিছু কথা বলার জন্য এসেছি। আল্লাহ পাক আপনাকে নারী পুরুষ উভয় জাতির জন্য পথ প্রদর্শক করে পাঠিয়েছেন । আমরা মহিলারা আপনার উপর ঈমান এনে আপনার অনুসারী হয়েছি । কিন্তু নারী ও পুরুষের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান আমরা লক্ষ্য করি । আমরা গৃহের মধ্যে আবদ্ধ । পুরুষের আকাঙ্খাপূরণ করি এবং তাদের সন্তানদের ধারণ ও প্রতিপালন করি । আর পুরুষরা জুমুয়া, জামায়াত ও জানাযার নামাযে শরীক হতে পারেন, হজ্জে যান । আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পুরুষরা জিহাদে গমন করেন । আর আমরা উনাদের সন্তানদের লালন পালন করি, ধন সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করি, সূতা কাটি । আমাদের প্রশ্ন হলো আমরা কি পুরুষদের ছওয়াবের অংশীদার হব না ? আমার পেছনে যে সব মহিলা আছেন উনাদেরও একই বক্তব্য ও একই মত । সুবহানাল্লাহ !
    নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আছমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার বক্তব্য শোনার পর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের দিকে চেহারা মুবারক ফিরিয়ে বললেন : তোমরা কি এর চেয়ে সুন্দর করে দ্বীন সম্পর্কে জানতে চায় এমন কোন মহিলার কথা শুনেছ ? উনারা বললেন : আমাদের তো ধারণাই ছিল না যে, একজন মহিলা এমন প্রশ্ন করতে পারেন । অত:পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আছমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনাকে লক্ষ্য করে ইরশাদ করলেন : নারী যদি তার স্বামীর সাথে সদাচরণ করে, তার মন যুগিয়ে চলে, তার ইচ্ছা অনিচ্ছায় আনুগত্য করে এবং দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব অধিকার পূরণ করে তা হলে সে পুরুষের সমান প্রতিদান লাভ করবে । যাও, একথা তোমার পেছনে রেখে আসা অন্য নারীদেরকে বলে দাও । সুবহানাল্লাহ !
    হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার যবান মুবারক থেকে এ কথা শোনার সাথে সাথেই হযরত আছমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তকবীর ধ্বনি দিতে দিতে অন্যান্য মহিলাদের নিকট ফিরে গিয়ে তা অবহিত করেন । সুবহানাল্লাহ !
    ইসলামের ইতিহাসে যে সকল বীরাঙ্গনা মুজাহিদের নাম পাওয়া যায় হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার নামটিও উনাদের শীর্ষে শোভা পায় । তিনি ছিলেন এমন এক পরিবারের মহিলা যাঁদের সকলে আল্লাহ পাক-উনার রসুলের নিরাপত্তার জন্য জীবন কুরবান করেছিলেন । উহুদের জিহাদ সহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার মাদানী জীবনের প্রতিটি সংকটময় মূহূর্তে এই পরিবারের লোকেরা উনাদের জীবনের বিনিময়ে আল্লাহ পাক-উনার রসুলের নিরাপত্তা বিধান করেছেন ।
    তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে অনেকগুলি অভিযানে অংশ গ্রহণ করেছেন । বাইয়াতুর রিদ্বওয়ান, মক্কা শরীফ বিজয় এবং খায়বর অভিযান তার মধ্যে অন্যতম । রাবীগণ এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, তিনি হিজরী ১৫ সনে সংঘটিত ইয়ারমুকের জিহাদেও যোগদান করেন এবং তাঁবুর খুঁটি দিয়ে পিটিয়ে একাই নয় জন রুমীয় সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন। সুবহানাল্লাহ ! (সিয়ারু আলামিন নুবালা)
    হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ইয়ারমুকের জিহাদের পরেও সুদীর্ঘকাল জীবিত ছিলেন । এক বর্ণনা মতে তিনি ইয়াযীদ-এর শাসন কাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন । দুরাচার ইয়াযীদ ৬৪ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করে। হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা দামিস্কে বসবাস করতেন এবং দামিস্কে বাবুছ ছগীরে উনার মাযার শরীফ বিদ্যমান রয়েছে (সিয়ারু আলামিন নুবালা)।
    (উসুদুল গাবা, ইছাবা, সিয়ারু আলামিন নুবলা, হায়াতুচ্ছাহাবা, অন্যান্য সীরত গ্রন্থাবলী)
    ৫. হযরত রুবাইয়েউ বিন্তু মুয়াওবিয রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা
    ইনিও আনছারদের বনু নাজ্জার গোত্রের মহিলা । যে সকল আনছার পরিবার ইসলামের সেবায় মহান ভূমিকা পালন করেছেন উনার পরিবারটি এর অন্তর্গত । ইসলামের প্রাথমিক যুগে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ইসলাম ও মক্কা শরীফ থেকে আগত মুসলমানদের সেবায় এই পরিবারটির রয়েছে গৌরবময় অবদান। আবু জাহলকে হত্যাকারীদের একজন এবং বদরের জিহাদের খ্যাতনামা সৈনিক প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত মু‘য়াওবিয ইবনুল হারিছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন উনার পিতা । উনার পিতার অন্যান্য ভাই সহ উনারা ছিলেন সাত ভাই । উনাদের মাতা ছিলেন হযরত ‘আফরা বিনতু উবায়দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা । উনারা উনাদের পিতার নামের চেয়ে মাতা হযরত ‘আফরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার নামের সাথে অধিক পরিচিত ছিলেন । ইতিহাসে উনারা أبناء عفراء (আবনাউ আফ্রা অর্থাৎ ‘আফরার পুত্রগণ) নামে প্রসিদ্ধ ।
    হযরত রুবাইয়ি‘উ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার দাদী হযরত ‘আফরা বিনতু উবায়দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা মদীনা শরীফে ইসলামের বাণী পৌঁছার সূচনাপর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে আগমনের পর অন্য আনছারী মহিলাদের সাথে তিনিও বাই‘য়াত গ্রহন করেন । বদরের জিহাদে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পতাকাতলে শামিল হয়ে উনার এই সাত ছেলে অংশগ্রহণ করেন এবং দুই জন শাহাদত বরণ করেন। সুবহানাল্লাহ !
    হযরত রুবাইয়ি‘উ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার পরিবারের লোকেরা জানত যে, এই উ¤মতের ফিরাউন আবু জেহেল ইসলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠায় প্রধান প্রতিবন্ধক । সে এমন ইতর প্রকৃতির যে আল্লাহ পাক-উনার রসুলকে কষ্ট দেয়, উনাকে গালি দেয়, দুর্বল মুসলমানদের উপর অত্যাচার চালায় এবং উনাদেরকে হত্যা করে। তাই হযরত রুবাইয়ি‘উ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার বাবা হযরত মু‘ওয়াবিয রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও চাচা হযরত মু‘য়ায রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বাগে পেলে এই নরাধমকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন । বদরের জিহাদে উনাদের এই সুযোগ এসে গেল । উনারা সাত ভাই বদরের জিহাদে অংশগ্রহণ করেন । এর পরের ঘটনা প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত আবদুর রহমান বিন ‘আওফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন ।
    হযরত আবদুর রহমান বিন ‘আওফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন : বদরের জিহাদে আমি সারিতে দাঁড়িয়ে ডানে বামে দাঁড়িয়ে দেখি আমার দুই পাশে অল্প বয়সের দুই তরুণ । তাদের অবস্থানকে আমার নিজের জন্য নিরাপদ মনে করলাম না । এমন সময় তাদের একজন অন্য সঙ্গী যেন শুনতে না পায় এমনভাবে ফিস ফিস করে আমাকে বলল : চাচা ! আমাকে একটু আবু জেহেলকে দেখিয়ে দিন । আমি বললাম : ভাতিজা ! তাকে দিয়ে তুমি কি করবে ? সে বলল: আমি আল্লাহ পাক-উনার সাথে ওয়াদা করেছি, যদি আমি তাকে দেখি, হয়ত তাকে হত্যা করব, নয়ত নিজে শহীদ হয়ে যাব । অন্যজনও আমাকে একই ভাবে একই কথা বলল । সুবহানাল্লাহ !
    হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন : তখন তাদের দুই জনের মাঝখানে আমি অবস্থান করতে পেরে নিজ মনে খুশী অনুভব করতে লাগলাম । আমি হাত দিয়ে ঈশারা করে তাদেরকে আবু জেহেলকে দেখিয়ে দিলাম । সাথে সাথে এই দুই তরুণ দু’টি বাজ পাখীর মত আবু জেহেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধরাশায়ী করেন । উনারা ছিলেন হযরত আফরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার দুই ছেলে হযরত মু‘যাওবিয ও হযরত মু‘য়ায রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা । আবু জেহেলকে হত্যার পর উনারা দুই জন বীর বিক্রমে শত্র“র উপর ঝাঁপিযে পড়েন । এই বদরের জিহাদেই হযরত রুবাইয়ি‘উ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার পিতা হযরত মু‘য়াওবিয রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও উনার চাচা হযরত মু‘য়ায রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শাহাদত বরণ করেন । সুবহানাল্লাহ !
    ইসলামের সেবায় অতুলনীয় ত্যাগের কারণে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পরিবারের সদস্যদের বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন । সব সময় তিনি উনাদের সুখ-সুবিধার খোঁজ খবর নিতেন ।
    হযরত রুবাই‘উ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার বিবাহের দিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত হয়েছিলেন । উনার উপস্থিতি সম্ভবত: উনার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য ছিল । কারণ, ইসলামের জন্য এই পরিবারটির ত্যাগ ও কুরবানী ছিল অতুলনীয় । ইসলামের জন্য এই পরিবার অর্থ-স¤পদ ব্যয় করেছে, শত্র“র বিরুদ্ধে জিহাদ করেছে এবং জীবনও দিয়েছে । সুতরাং পিতৃহারা এই মেয়েটি যিনার পিতা আবু জেহেল-এর ঘাতক এবং যিনি বদরের জিহাদে শাহাদত বরণ করেছেন, উনার আনন্দের দিনে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে সান্ত¦না দানের জন্যই উপস্থিত হয়েছিলেন । সুবহানাল্লাহ !
    হযরত রুবাইয়ে‘উ বিন্তে মু‘য়াওবিয রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ছিলেন একজন মহিয়সী নারী । সাহসিকতা ও বিদ্যাবুদ্ধি সর্বক্ষেত্রেই তিনি মুসলিম নারীদের আদর্শ স্থানীয়া । তিনি বাইয়াতুর রিদ্বওয়ানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বহু যুদ্ধ বিগ্রহে তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে শরীক ছিলেন । অপরাপর নারীর মত যুদ্ধক্ষেত্রে উনার কাজ ছিল যোদ্ধাদের পানি পান করানো, আহতদের সেবা করা এবং নিহত সৈনিক ও মারাত্মকভাবে আহতদেরকে মদীনা শরীফে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা । সুবহানাল্লাহ !
    বহু জিহাদে তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে শরীক ছিলেন । ফলে তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাকে অতি নিকট হতে জানার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং সেই সুযোগে শরীয়তের জ্ঞানে নিজকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । চতুর্দিকে উনার জ্ঞানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল । বিভিন্ন বিষয়ে লোক উনার নিকট প্রশ্ন করতে আসত এবং তিনি উহার সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করতেন । তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বহু হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন । সুবহানাল্লাহ !
    একবার হযরত আবু উবায়দা ইবনে মুহ¤মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি একবার উনাকে অনুরোধ করেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাকে কেমন দেখা যেত তার বর্ণনা দিন । তিনি বললেন: বৎস ! তুমি যদি উনাকে দেখতে তা হলে একটি উদীয়মান সূর্যকেই দেখতে পেতে । সুবহানাল্লাহ !
    মুহম্মদ ইবনে ইয়াস আল-লায়ছী রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন হযরত রুবাই‘উ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর পুত্র, যিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত তাবেঈ । তিনি স্বীয় মাতা হতে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন । (উসুদুল গাবা, তাবাকাত, ইছাবা, হাদীছ শরীফের অন্যান্য কিতাবাদিী)
    ৬. হযরত উম্মে ওয়ারাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা
    আনছারী ছাহাবিয়া । পিতার নাম আবদুল্লাহ ইবনুল হারিছ বিন উওয়াইমির বিন নওফল । উ¤েম ওয়ারাকা উপনামেই প্রসিদ্ধ, আসল নাম জানা নেই । নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে তশরীফ আনার পর ইসলাম গ্রহণ করেন । তিনি বদরের জিহাদে শরীক হয়ে আহতদের সেবা শুশ্রষা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং শাহাদত লাভেরও আকাঙ্খাপ্রকাশ করেন । তিনি বলেন : হে আল্লাহ পাক-উনার রসুল ! আপনি যদি আমাকে আপনাদের সাথে জিহাদে যেতে অনুমতি দেন, তবে আপনাদের অসুস্থ লোকদের সেবা-শুশ্রষা করব এবং আপনাদের আহত লোকদের ঔষধ সেবন করাব, হতে পারে মহান আল্লাহ পাক আমাকে শাহাদত নছীব করবেন । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন : يا أم ورقة ، اقعدى فى بيتك فإن الله سيهدى إليك شهادة فى بيتك – (হে উম্মে ওয়ারাকা ! তোমার নিজ গৃহে অবস্থান করতে থাক, আল্লাহ পাক তোমাকে নিশ্চয়ই তোমার নিজ গৃহেই শাহাদত দান করবেন) (ইছাবা) । মূলত: এই দিন থেকেই নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে শহীদ হিসাবে আখ্যায়িত করেন । তিনি মাঝে মাঝে উনাকে দেখার জন্য উনার বাড়ীতে ছাহাবীদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন । তিনি বলতেন : إنطلقوا بنا نزور الشهيدة (তোমরা আমার সাথে চল, আমরা এই মহিলা শহীদকে একটু দেখে আসি). হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার এই জাতীয় কথা দ্বারা এই মহিলা যে শহীদ হবেন সেদিকেই ইঙ্গিত করতেন । সুবহানাল্লাহ !
    (হেলইয়াতুল আওলিয়া)
    হযরত উম্মে ওয়ারাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা কুরআন মজীদ শিক্ষা করেছিলেন এবং কুরআন শরীফের বেশীর ভাগ মুখস্ত করেন । এক বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি সমগ্র কুরআন শরীফ সংগ্রহ করেন । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে উনার পরিবারের মহিলাদের ইমামতি করার অনুমতি দিয়েছিলেন । উনার জন্য একজন মুয়াজ্জিনও নিযুক্ত করা হয়েছিল । সুবহানাল্লাহ ! ইসলামের ইতিহাসে তিনিই প্রথম মহিলা যিনার বাড়ীতে মেয়েদের জন্য মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা‘লীম তালক্বীন-এর ব্যবস্থা করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, মহিলাদের ইমামতি শুধু উনার জন্যই খাছ ছিল । উনার আগে বা পরে আর কোন মহিলাকে ইমামতির অনুমতি দেয়া হয় নি। আর নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানায় মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতের নামায আদায় করার অনুমতি । কিন্তু পরবর্তীতে হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম উনার যামানায় ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের ইজমা-এর ভিত্তিতে ইহা নিষিদ্ধ হয়ে যায় ।
    তিনি উনার এক গোলাম ও দাসীকে কথা দিয়েছিলেন যে, তারা উনার মৃত্যুর পর আযাদ হয়ে যাবে। হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম-উনার খিলাফতকালে এই গোলাম ও দাসী আযাদ হওয়ার লোভে এক রাত্রে উনাকে হত্যা করে ও একটি চাদর দ্বারা ঢেকে রেখে পলায়ন করে । নাউজু বিল্লাহ ! সকালে হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম তিনি লোকদেরকে বললেন : আজ রাত্রে খালা হযরত উম্মে ওয়ারাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-উনার কুরআন শরীফ তিলাওয়াত শুনতে পাই নি, উনার কি হয়েছে সন্ধান করে দেখ । তারা উনাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায় । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হল । খালা শহীদ হলেন । সুবহানাল্লাহ ! অত:পর হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম মসজিদের মিম্বরে আরোহণ করে বললেন : গোলাম ও দাসীকে সন্ধান করে গ্রেপ্তার কর । তারা ধৃত হয়ে আসল এবং নিজেদের দোষ স্বীকার করল। তাদেরকে শূলে দিয়ে হত্যা করা হলো । হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম তিনি বলেন : আল্লাহ পাক-উনার রসুল সত্য বলেছেন যখন তিনি বলতেন : إنطلقوا بنا نزور الشهيدة (তোমরা আমার সাথে চল, আমরা এই মহিলা শহীদকে একটু দেখে আসি). সুবহানাল্লাহ ! মদীনা শরীফে এই ধরণের মৃত্যু দন্ড এই প্রথম ছিল । সূত্র : উসুদুল গাবা, ইছাবা, হেলইয়াতুল আওলিয়া
    সার্বিক আলোচনা
    সকল মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না-উনাদের জীবনী মুবারক আলোচনায় একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য এই যে, নবুয়ত প্রকাশের প্রথম থেকে হিজরী ৫ সনের জিলক্বদ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ১৮ বছর পর্দ্দা পালনের ব্যাপারে আল্লাহ পাক-উনার তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ জারী হয় নি । এই সময়ে আরবে তৎকালীন সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী মহিলাগণ চলাফেরা করেছেন। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুমতিক্রমে মদীনা শরীফে মুহাজির ও আনছার মহিলা ছাহাবীগণ বিভিন্ন জিহাদেও অংশগ্রহণ করেছেন। হিজরী ৫ম সনের শাওয়াল মাস পর্যন্ত ইসলামের বড় বড় জিহাদগুলি যেমন বদর, উহুদ ও খন্দক সমাপ্ত হয় । হিজরী ৫ম সনের জিলক্বদ মাসে পর্দ্দা পালন ফরয করে কুরআন শরীফে সুনির্দিষ্ট আয়াত শরীফ নাযিল হয়। পর্দ্দা পালন ফরয হওয়ার পর থেকে সব মহিলা ছাহাবীই জিহাদের ময়দানেও শরীয়ত সম্মত পর্দ্দা পালন করেছেন। বিভিন্ন হাদীছ শরীফে এবং সীরত-গ্রন্থাবলীতে উল্লেখিত ঘটনাবলীতে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
    আমি যে কয়জন হযরত আনছার মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না-উনাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী মুবারক আলোচনা করেছি, এতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, হযরত আনছার মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্নাগণ সত্যিকারভাবে আনছার বা সাহায্যকারী মহিলা ছিলেন, যেরূপ আল্লাহ পাক উনাদেরকে কালাম পাকে নামকরণ করেছেন। উনারা জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন, আহত-অসুস্থ লোকদের সাহায্য করেছেন । উনারা জিহাদে পুরুষ ছাহাবীদের ন্যায় বীরত্ব ও আত্মত্যাগ প্রদর্শন করেছেন । তদুপরি উনাদের মেহমানদারী, সৎসাহস, ধৈর্য, জ্ঞান-চর্চা ইত্যাদিও অতুলনীয় ছিল। উনাদের অনেকেই ইসলামের প্রথম দিকে বিভিন্ন জিহাদে অংশ গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে সার্বিকভাবে উনাদের জ্ঞান চর্চা, পারিবারিক তা’লীম এবং সর্বোপরি আ’ম মহিলাদের তা’লীম তালক্বীনই ছিল প্রধান কাজ।
    হযরত উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম এবং আহলে বায়ত শরীফ উনাদের সম্মানিত মহিলা সদস্যগণ এবং শীর্ষ-স্থানীয় মুহাজির মহিলা ছাহাবীগণ উনারাই ছিলেন আনছার মহিলা ছাহাবীগণ উনাদের মুয়াল্লিমা বা শিক্ষিকা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, মুহাজির মহিলা ছাহাবী হযরত হামনা বিনতে জাহাশ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, তিনি ছিলেন হযরত মুছয়াব ইবনে উমায়র রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আহলিয়া । হযরত মুছয়াব বিন উমায়র রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হিজরতের পূর্ব থেকে হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নির্দেশে মদীনা শরীফে সর্ব-প্রথম ইসলামের প্রচার ও প্রসার কাজ শুরু করেন। আর উনার আহলিয়া হযরত হামনা বিনতে জাহাশ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনিও উনার স্বামীর সাথে আনছার মহিলাদের মধ্যে প্রচার কার্য চালিয়ে যান । আর এই হামনা বিনতে জাহাশ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত যায়নব বিনতে জাহাশ আলাইহাস সালাম উনার বোন । উম্মুল মু’মিনীন হযরত যায়নব বিনতে জাহাশ আলাইহাস সালাম উনার বিছাল শরীফ হয় হিজরী ২০ সনে । হযরত হামনা বিনতে জাহাশ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার বিছাল শরীফ হয় উনার বোনের বিছাল শরীফের পরে । কাজেই তিনি যেমন উনার স্বামী মদীনা শরীফে ইসলামের প্রথম প্রচারক হযরত মুছয়াব বিন উমায়র রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ছোহবত পেয়েছেন এবং একসঙ্গে মহিলাদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করেছেন, তেমনি উনার বোন উম্মুল মু’মিনীন হযরত যায়নব বিনতে জাহাশ আলাইহাস সালাম উনার ছোহবতও পেয়েছেন এবং হিজরী ২০ সনের পর পর্যন্ত আনছার মহিলা ছাহাবীদের শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত ছিলেন । কাজেই আনছার মহিলা ছাহাবীদের মধ্যেও উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাব অনস্বীকার্য । হযরত উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালামগণ উনাদের মধ্যে দশ জন নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফ (অর্থাৎ হিজরী ১১ সন)-এর পরেও সুদীর্ঘ হায়াত মুবারক পেয়েছিলেন । উনারা হিজরী ১১ সন থেকে হিজরী ৬৩ সন পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় অর্ধ শতাব্দি (সর্বশেষে হযরত উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম-উনার বিছাল শরীফ পর্যন্ত) সর্ব স্তরের স্ত্রীজাতীর শিক্ষা-দীক্ষায় ব্যপৃত ছিলেন । আনছার মহিলা ছাহাবীগণও এই ফায়দা প্রাপ্ত হয়েছেন ।
    আমাদের পরম সম্মানিত উম্মুল উমাম হযরত আম্মা হুযূর ক্বিবলা আলাইহাস সালাম তিনি হযরত উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম, আহলে বায়ত শরীফ আলাইহিন্নাস সালাম এবং শীর্ষ স্থানীয় মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না উনাদের সুযোগ্য ক্বায়েম-মক্বাম এবং পূর্ণ মিছদাক। সুবহানাল্লাহ। তিনি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সম্মানিত আওলাদ। আমরা জানি মুজাদ্দিদে আযম, আমাদের হযরত মামদুহ মুর্শিদ ক্বিবলা আলাহিস সালাম হিদায়েতের উদ্দেশ্যে সারা বাংলাদেশ ব্যাপী মাহফিল করেছেন এবং উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের সুন্নত হিসাবে সব সময় উম্মুল উমাম হযরত আম্মা হুযূর ক্বিবলা আলাইহাস সালাম এবং আহলে বায়ত শরীফ উনারা সফরে উনার সঙ্গে তশরীফ নিতেন । সে সময় খারেজী ওহাবীদের শত্রুতার কারণে অনেক মাহফিলই জিহাদের রূপ পরিগ্রহ করত। এসব কঠিন মূহূর্তে হযরত আম্মা হুযূর ক্বিবলা আলাইহাস সালাম এবং আহলে বায়ত শরীফের সম্মানিত সদস্যগণ কিরূপ ধৈর্যের সাথে মুকাবিলা করেছেন তা প্রত্যক্ষদর্শী আমাদের পীরভাইগণ জানেন।
    সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে উম্মুল উমাম হযরত আম্মা হুযূর ক্বিবলা আলাইহাসা সালাম হযরত মুজাদ্দিদে আযম আলাইহিস সালাম উনার নির্দেশনা অনুযায়ী মহিলাদেরকে আহলে সুন্নাত আল-জামায়াতের আদর্শে খালেছ ফিকাহের ইলেম ও তাছাউফের ইলেম শিক্ষার ব্যবস্থা করছেন। শরীয়ত সম্মত খালেছ পর্দ্দার মধ্যে একটি আদর্শ বালিকা মাদ্রাসা উনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে, যা আদর্শ ও উচ্চ-শিক্ষিতা মহিলা মু’য়াল্লিমগণ দ্বারা পরিচালিত। সব মহিলা শিক্ষিকা ও ছাত্রিদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাছাউফের শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে । আমরা শুনেছি বালিকা মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা এতই সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক যে, বাইরের যে কোন বালক মাদ্রাসাকেও হার মানায়। তদুপরি তিনি বহিরাগত ’আম মহিলাদেরকেও নিয়মিতভাবে তা’লীম তালক্বীন ও তাছাওফের শিক্ষা ও ফয়েজ তাওয়াজ্জুহ দিয়ে যাচ্ছেন। এতদ্ব্যতীত উনার অসংখ্য কারামত ও কামালাতের বাস্তব দৃষ্টান্ত আমাদের অনেক পীর বোনের জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে, উনার দোয়া লাভে দুনিয়া আখিরাতে উনারা উপকৃত হয়েছেন, অনেক মহিলার একদিনেই সুলতানুল আজকার জারী হয়েছে । সুবহানাল্লাহ !
    বর্তমান যামানায় সারা পৃথিবীতে এইরূপ শিক্ষা ব্যবস্থা কোথাও নেই। কারণ নাম মাত্র তথাকথিত ফিক্বাহের ইলেমের শিক্ষা ব্যবস্থা পৃথিবীর কোন কোন স্থানে পাওয়া গেলেও খালেছ সুন্নতের অনুসরণে ফিক্বাহ ও তাছাওফ শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বলিত কোন মহিলা বা বালিকা মাদ্রাসা নেই । বর্তমানে দেশে বিদেশে তথাকথিত সুন্নী মাদ্রাসাগুলিও বেপর্দ্দায় ভরে গেছে, মাদ্রাসায় স্কুল কলেজের ন্যায় ছাত্র-ছাত্রি, শিক্ষক শিক্ষিকা একত্র সমাবেশ করে বেপর্দ্দেগী ও বেহায়াপণায় পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, এখনকার মাদ্রাসাগুলিতেও ছাত্রি ও শিক্ষিকাদের নির্দিষ্ট কোটা করা হয়েছে। আর সারা পৃথিবীতে খারেজী, ছলফী ও লা-মাযহাবী মাদ্রাসাগুলি যদিও তারা ইসলামী শিক্ষার ঢাক ঢোল পিটিয়ে সাধারণ লোকদেরকে প্রতারিত করে, তারা যে তাছাউফ শিক্ষা বিবর্জিত এবং বদ আক্বীদায় পরিপূর্ণ তা হক্ব পন্থী লোক অবশ্যই জানেন।
    আমাদের জানা আছে যে, কোন কোন সুন্নী পরিবারও সুরা কেরাত শিক্ষার জন্য ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে নুরানী মাদ্রাসায় দিয়ে থাকে যা সম্পূর্ণ খারেজী ওহাবী দলের লোকেরা পরিচালনা করে থাকে এবং কেউ কেউ বাসায় প্রাইভেট পড়ানোর জন্যও খারেজি লোক নিয়োগ করে থাকে । অভিভাবকগণ এসব শিক্ষক সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর থাকে। এতে হীতে বিপরীত হয়। ইসলামী শিক্ষা তো হয়ই না, আদব কায়দাও হয় না। বাচ্চাদেরকে এ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখা উচিত।
    আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানে সবচেয়ে বড় ফিত্বনা হচ্ছে পর্দ্দাহীনতা, ছবি এবং রুহানিয়ত বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা। একটি পরিবারে মাতা হচ্ছেন সন্তান-সন্ততিদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষক । অথচ আমাদের দেশে অধিকাংশ পারিবারিক পরিবেশে অবস্থিত প্রতিটি ঘর হারাম টিভি, ভিসিআর এবং ছবিযুক্ত খবরের কাগজ দিয়ে আল্লাহ পাক উনার রহমত শূণ্য শয়ত্বানের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। অপরদিকে ’আম মহিলাগণ বেপর্দ্দা ও বেপরওয়াভাবে বেগানা পুরুষদের সাথে বাসে, হাটে বাজারে একসঙ্গে চলছে, চাকুরী বাকুরীতে অংশ গ্রহণ করছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে। অথচ পিতা মাতা সন্তান সন্ততিদের পারিবারিক ভাবে সত্যিকার তা’লীমের কোন ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।
    আমাদের মামদুহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম তিনি প্রতি শুক্রবারেই মহিলাদের তা’লীমের জন্য উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফে আম ভাবে সব সময় আহ্বান করে আসছেন । ইহা আমাদের জন্য এক অতি বড় নিয়ামত । আমরা যেন আমাদের অধিনস্থ মহিলাদেরকে হযরত আম্মা হুযূর ক্বিবলা আলাইহাস সালাম উনার খেদমতে প্রেরণ করে মহান আল্লাহ পাক উনার নিয়ামতের হক্বদার হতে পারি, সেই তৌফিক যেন মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে দান করেন। আমীন ।
    অবশেষে মামদুহ মুরশিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম ও উনার সম্মানিত আহলে বায়ত শরীফ আলাইহিমুস সালাম-উনাদের পাক কদমে আমার সমস্ত ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে আমি আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি । আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু ।
    সাঈদ আহমদ গজনবী

    https://fitrat2020.wordpress.com/2013/02/
    • Blogger Comments
    • Facebook Comments

    0 মন্তব্য(গুলি):

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    Item Reviewed: হযরত আনছার মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না-উনাদের ফযীলত মুবারক Rating: 5 Reviewed By: Baitul Hikmah
    Scroll to Top