৫৫০ হিজরী সনের কোন এক রাত্রে বিশিষ্ট বুযুর্গ, ন্যায়পরায়ণ মুসলমান বাদশাহ নুরুদ্দীন
রহমতুল্লাহি আলাইহি ইশার নামাযের পর মধ্যরাত পর্যন্ত পবিত্র কালামে পাক তিলাওয়াত করতঃ তাহাজ্জুদের নামায পড়ে দোয়া ও মুনাজাতের পর ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের মধ্যে জিয়ারত হয় আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার। স্বপে¦ তিনি নূরুদ্দীনকে লক্ষ্য করে বলছেন, “হে নুরুদ্দীন, দীর্ঘদিন যাবৎ দুজন লোক আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, আর আমার সঙ্গে চরম বেয়াদবীতে লিপ্ত আছে। এ দু বেয়াদবকে ধরে যথা সম্ভব দ্রুত এদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান কর।” দুজনের চেহারাও তাঁকে দেখানো হয়। বুযুর্গ বাদশাহ নূরুদ্দীন রহমতুল্লাহি
আলাইহি এ স্বপ্ন দেখে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে গভীর চিন্তা মগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- উনার সঙ্গে কুচক্রী এ লোক দুজন এমন কী বেয়াদবী করতে পারে? যে কারণে আখিরী রসূল, হায়াতুন্ নবী, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এদেরকে দ্রুত শাস্তি প্রদানের জন্যে কঠোর নির্দেশ প্রদান করতে পারেন। লোক দুজনের চেহারাও আমাকে দেখানো হল, এরাই বা কারা? কোত্থেকে আগমন, কী উদ্দেশ্য এদের? গভীর চিন্তায় বিভোর বাদশাহ নুরুদ্দীন বিচলিত অবস্থায় অযু গোসল করলেন এবং তাড়াতাড়ি দু’রাকায়াত নামায আদায় করে দীর্ঘসময় পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ পাক উনার দরবারে ক্রন্দনরত অবস্থায় মুনাজাত করলেন।
পার্শ্বে এমন কেউ নেই যে, তার সঙ্গে কিছু পরামর্শ করবেন আর এ স্বপ্নও এমন নয় যে, কারও কাছে ব্যক্ত করবেন। চিন্তায় বিভোর হয়ে তিনি পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু অনেক চিন্তা করেও ঘুমাতে পারছিলেন না। দীর্ঘক্ষণ পরে অবশেষে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- উনার জিয়ারত লাভ করলেন তিনি। পিছনে গোল চেহারা বিশিষ্ট দুজন। এদের কে উদ্দেশ্য করে তিনি দৃপ্ত কক্তে বলছেন, “হে নুরুদ্দীন! তুমি এই দু চরম বেয়াদবকে ধর, আর এদেরকে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রদান কর।” বাদশাহ নূরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উচ্চস্বরে ইয়া আল্লাহ্! ইয়া আল্লাহ্! বলতে বলতে বিছানা থেকে উঠে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়েন, কোথায় যাবেন, কি করবেন, কোন পথ না পেয়ে তাড়াতাড়ি অযু গোসল করলেন, জায়নামাযে গিয়ে অত্যধিক ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় দু’রাকায়াত নামায আদায় করে দীর্ঘ সময় অশ্রুসিক্ত নয়নে মুনাজাত করলেন। দু’বার আল্লাহ্ পাক উনার নবীর আগমন এবং লম্বা জামা, পাগড়ীধারী, তাসবীহ হাতে, গোল চেহারা বিশিষ্ট দু ব্যক্তির চরম বেয়াদবীর জন্যে এদেরকে শাস্তি প্রদানের নির্দেশ-তিনি কিছুই স্থির করতে পারছেননা। রাত্রি এখনও বাকী আছে। জানালা দিয়ে বারান্দার দিকে দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেখানে মনে হল গোল চেহারা বিশিষ্ট ঐ দুজন তাকে ধরার জন্যে তার দিকে ধেয়ে আসছে। তিনি গায়ে কম্বল জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন, ভোলার চেষ্টা করলেন ঐ দুজন চেহারা, কিন্তু কোন মতেই ভুলতে পারলেন না। ক্রমান্বয়েই ভয় গাঢ় থেকে গাঢ় হচ্ছে তার মনের গহীনে।
তিনি নিরূপায় হয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় দোয়া-দরূদ পাঠ করতে করতে পুনরায় তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েন। এমন সময় আবারো অতি নিকট হতে আল্লাহ্ পাক উনার নবীর জিয়ারত লাভ করলেন। এবার আগের চেয়ে আরো বেশী দৃঢ়কক্তে আখিরী রসূল, হায়াতুন্ নবী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, “নূরুদ্দীন! এই দু বেয়াদবকে আল্লাহ্ পাক ইচ্ছা করলে এখনি গযব দিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববাসী এদের ধ্বংসের মূল কারণ সম্পর্কে অনবহিত থেকে যাবে, আমি চাচ্ছি এদের এ চরম বেয়াদবীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে বিশ্ববাসীর সামনে একটা নজির রেখে যাও। এ তিন বেয়াদবকে পাকড়াও করে সমুচিত শাস্তি প্রদান কর। দীর্ঘদিন যাবৎ এরা আমার সঙ্গে চরম বেয়াদবী করছে।” বাদশাহ নূরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি ক্রন্দনরত অবস্থায় বিছানা ত্যাগ করে পুনরায় অযূ করে ফযরের নামায আদায় করলেন। নামায শেষ করে দ্রুতগামী ঘোড়া নিয়ে প্রধান উজীরের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে আর একটি দ্রুতগামী ঘোড়ার উপর সাওয়ার করিয়ে বাড়ীতে নিয়ে এলেন। অতঃপর গোপন কক্ষের দরজা বন্ধ করে প্রকাশ না করার শর্তে আদ্যপান্ত স্বপে¦র কথা ব্যক্ত করলেন এবং এখন কি করণীয় সে বিষয়ে পরামর্শ ত্বলব করলেন। উজীরে আযম স্বপ্নের বৃত্তান্ত অবগত হয়ে সংগে সংগে বলে ফেললেন, হুযুর! আপনি এখনও এখানে বসে রয়েছেন! রওজা শরীফ বা আশ-পাশে কঠিন কোন কিছু হয়েছে এবং সে বিষয়ে তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে নির্দেশ দিচ্ছেন।
কালবিলম্ব না করে অতি সত্ত্বর নির্দেশ পালনার্থে মদীনার পথে বের হয়ে পড়ুন।
কালবিলম্ব না করে খুব ভোরে বাদশাহ নূরুদ্দীন ১৬ হাজার দ্রুতগামী আশ্বারোহী সৈন্য এবং বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে মদীনাভিমুখে রওয়ানা হলেন। দীর্ঘ ১৬ দিন পর মদীনার দ্বারদেশে উপনীত হয়ে সৈন্যসামন্তসহ অজু করে দু’রাকায়াত নফল নামায পড়ে দীর্ঘ সময় ধরে মুনাজাত করলেন। অতঃপর সমস্ত সৈন্য দ্বারা মদীনা শরীফকে ঘেরাও করে ফেললেন এবং শাহী ফরমান জারী করে দিলেন যে “বহিরাগত লোক মদীনায় আসতে পারবে কিন্তু মদীনা শরীফ থেকে কোন লোক বাইরে যেতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত বাদশাহ্ নূরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দ্বিতীয় ফরমান জারী না হবে।” বাদশাহ নূরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি জুমার দিন খুৎবা দান করলেন এবং ঘোষণা করলেন, “আমি মদীনাবাসীকে দাওয়াত খাওয়াতে ইচ্ছা করেছি। আমার ইচ্ছা কেউ যেন এ দাওয়াত থেকে বঞ্চিত না হয়।”
তিনি কয়েক হাজার ভেড়া, দুম্বা, উট জবেহ করে মদীনা শরীফ এবং মদীনা শরীফের পার্শ্ববর্তী দূর-দূরান্তের সর্বশ্রেণীর লোককে দাওয়াত দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাদ্য খাওয়ালেন এবং প্রত্যেকের নিকট অনুরোধ রাখলেন যে, “মদীনা শরীফ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার কোন লোক যেন এ দাওয়াত থেকে বঞ্চিত না হয়।” সপ্তাহ ব্যাপী শত সহস্র ভেড়া, দুম্বা, উট জবেহ করে হাজার হাজার লোককে খাদ্য খাওয়ান। আর অনুরোধের উক্তি পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আগে পরে এভাবে প্রচার করা হল। যারা দূর-দূরান্ত থেকে আসতে পারেননি তাদেরকেও ঘোড়া ও গাধার পিঠে চড়িয়ে আনা হল। প্রায় পনর দিন পর্যন্ত অগণিত লোক শাহী দাওয়াতে শরীক হওয়ার পর তিনি বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হলেন যে, সকলেই বাদশাহর দাওয়াতে হাজির হয়েছেন, আর কেউ বাকী নেই। কিন্তু অনুক্ষণ তিনি কি যেন ভাবছেন, বিমর্ষ বদন, অস্থির চিত্ত। তিনি চিন্তা করছেন, সকলেই যদি দাওয়াতে শরীক হয়ে থাকে তাহলে স্বপে¦ দর্শিত ঐ দু’ব্যক্তি কোথায়? তাদের অনুসন্ধান কিভাবে করা যায়? আর কিভাবে তাদের পাকড়াও করা সম্ভব?
অতঃপর আবার নতুন করে ঘোষণা করলেন, “মদীনার লোকদের এখনো দাওয়াত খাওয়া শেষ হয়নি। বহুলোক আমার এ দাওয়াতে শরীক হতে বাকী আছে। অতএব, মদীনার মুসল্লিগণকে অনুরোধ করা যাচ্ছে তারা যেন অতিসত্ত্বর অনুসন্ধান করে ঐ সমস্ত লোকদেরকে সংবাদ দিয়ে দাওয়াতে হাজির করেন।” একথা শ্রবণে মদীনার মুসল্লিগণ সকলেই একবাক্যে বলে উঠলেন, “হুযূর! মদীনার আশ-পাশে এমন কোন লোক আর বাকী নেই, যারা আপনার দাওয়াতে শরীক হয়নি।” তখন বাদশাহ নূরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি বলিষ্ঠ কক্তে বললেন, “আমি বলছি আপনারা ভালভাবে অনুসন্ধান করুন, এখনও কিছু লোক দাওয়াত খেতে বাকী রয়েগেছে। কেন তারা আমার এ দাওয়াতে শরীক হল না? তারা কোথায় এবং তারা কারা? তাদেরকে আপনাদের খোঁজ করে আনতে হবে।” বাদশাহ নূরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বলিষ্ঠ কক্তে এ ঘোষণা মদীনার আকাশ-পাতালে যেন এক প্রকম্পন তুলে দিয়েছিল। একদিকে তাঁর পবিত্র চেহারায় অনুতাপের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে অপরদিকে দরদ যেন উথলে পড়ছিল কক্ত থেকে। বিশাল জনতার ভরা মজলিসে হঠাৎ একজন লোক বলে উঠল, “হুযূর! আমার মনে হয় মাত্র দু’জন লোক বাকী আছে। যারা কারো কোন হাদীয়া, দান, তোহফা গ্রহণ করে না, এমনকি তারা কখনো কারও দাওয়াতেও শরীক হয় না। আমার মনে হয় সেই দু’জন লোক আপনার দাওয়াতে শরীক হয়নি।”
বাদশাহ নূরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি কাল-বিলম্ব না করে কয়েকজন লোকসহ কাঙ্খিত লোকদ্বয়কে দাওয়াতের অনুরোধের জন্য নিজেই তাদের বাসস্থানে উপস্থিত হলেন। উপস্থিত হয়ে দরজা বন্ধ দেখতে পেলেন। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করার পর প্রহরী দরজা খুলে দিল এবং বললো যে, আপনারা অপেক্ষা করুন, তারা সকলেই নামায-কালাম ও দোয়াতে ব্যস্ত আছেন। বাদশাহ সে দু’ব্যক্তির দ্বারদেশে স্বয়ং উপস্থিত। কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করার পর প্রহরীর কোন খবর না পেয়ে বাদশাহ ক্রোধ সংবরণ করতে পারছিলেন না। অপর দিকে কে যেন তাকে পিছন থেকে তাড়া করছে, তুমি তাড়াতাড়ি ঘরে প্রবেশ কর আর তাদের ভালভাবে অবলোকন কর, তারা কারা? প্রহরী ও বাড়ীওয়ালার অনুমতি না নিয়েই তিনি বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং স্বচক্ষে দেখলেন একজন নামাযে আর একজন মুনাজাতে মশগুল। তিনি তাড়াতাড়ি নামায ও দোয়া শেষ করতে আদেশ দিলেন। যথাকাজ সমাপনান্তে দু’জনই বাদশাহ নূরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সামনে এসে হাজির হল। বাদশাহ বিনম্র কক্তে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কে এবং কোথা থেকে এসেছ? তোমরা বাদশাহর দাওয়াতে শরীক হলে না কেন?” তারা নিজকে গোপন করে বললো, “আমরা মুসাফির, দীর্ঘদিন যাবৎ এখানে আছি। আমরা কারও দাওয়াত গ্রহণ করিনা। এক আল্লাহ্র উপর নির্ভরশীল। আমরা সব সময় ইবাদত, রিয়াজত ও পরকালের চিন্তা ফিকিরে ব্যস্ত আছি। কুরআন তিলাওয়াত আর নফল নামাযে সময় শেষ হয়ে যায়, দাওয়াত খাওয়ার সময় আমাদের নেই।”
বাদশাহর সাথের মদীনাবাসীগণ ওদের ছানাছিফত করে বললো যে, “হুযূর! এরা দীর্ঘদিন যাবৎ এখানে অবস্থান করছে, এরা খুব ভাল লোক। এরা দরিদ্র গরীব শ্রেণীর লোককে প্রচুর অর্থ-সম্পদ দিয়ে সাহায্য করে থাকে। এদের দানের উপর অত্র অঞ্চলের অনেক লোকের জীবিকা নির্বাহ হয়।” বাদশাহ্ নূরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি এদেরকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিন্ত হলেন, এরা সেই দু বেয়াদব যাদেরকে তিনি স্বপ্নের মাধ্যমে দেখেছিলেন। তিনি আবার তাদেরকে প্রশ্ন করলেন “তোমরা কারা? কোথা থেকে এসেছ? তোমরা কি কাজে ব্যস্ত আমাকে সঠিক সংবাদ প্রদান কর।”
তারা সকলেই সমস্বরে বললো, “পবিত্র হজ্বজব্রত পালনের জন্য এখানে এসেছি এবং পবিত্র রওজা মুবারকের নৈকট্য লাভের জন্য এখানে অবস্থান করছি।” ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ নূরুদ্দীন চরম ধৈর্য্যরে সাথে এদেরকে আবার প্রশ্ন করলেন, এখানে তোমরা কি কর আমাকে সত্য কথা বল।” বাদশাহ প্রশ্ন করছিলেন আর তাদের বসবাসের ঘরটিকেও ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। মদীনার গণ্যমান্য লোকেরা ওদের প্রশংসায় করে বলছিলেন যে, “এরা খুবই ভাল লোক, এদের আচরণে মদীনাবাসী মুগ্ধ এবং এদের সাহায্য সহানুভূতি দ্বারা বহু লোক উপকৃত। গত কয়মাস আগে মদীনায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সে সময় বহু লোক অর্ধাহারে, অনাহারে দিনাতিপাত করে, সে কঠিন সময়ে এই দু দরবেশের অবদানে অনেক লোকের উপকার হয়েছে। তারা দিনের বেলায় রোযা রাখেন আর রাত্রির বেশীর ভাগ সময় ইবাদত তথা জান্নাতুল বাকী জিয়ারতে মশগুল থাকেন।” ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ মাথা হেলিয়ে আগ্রহভরে ধৈর্য্যরে সাথে, নীরবে তাদের সমস্ত কথা শ্রবণের পর জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, “আমি তোমাদের কারও কথা শুনতে রাজী নই। তোমাদের এই বৈঠকখানা বাদ দিয়ে আসল শোবার কক্ষ কোথায় আমাকে সংবাদ দাও।” তিনি সঙ্গের লোকজনসহ একটি পর্দা উঠিয়ে নতুন এক কক্ষে প্রবেশ করলেন। তাদের এই গোপন কক্ষে তিনি মাটি, ধূলা-বালি যুক্ত কিছু পোশাক পরিচ্ছদ দেখতে পান। অতঃপর তিনি সেই গোপন কক্ষে পদচারণা করতে করতে তাদের বিছানা উঠিয়ে দেখতে পান একখানা পাথর। পাথরখানা সরাতেই তিনি তার নিম্নভাগে দেখলেন গভীর একটি কুপ এবং সে কুপ থেকে নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- উনার রওজা মুবারকের দিকে একটি সূড়ঙ্গ। আর কালবিলম্ব না করে দু’জনকে তাদের আসবাবপত্রসহ মসজিদে নববীর সামনের এক চত্ত্বরে এনে হাজির করলেন। অতঃপর ১৬ হাজার সৈন্যকে মদীনার পাহারা থেকে নিস্কৃতি দান করেন।
লক্ষাধিক জনতার ভীড়ে বাদশাহ সেই দু’জনকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কে? কোথা হতে তোমাদের আগমন এবং তোমাদের উদ্দেশ্য কি? পরিস্কার ভাষায় বল। এই অবস্থায় তাদের কঠিন বিপদ সামনে দেখে একটি মত অনুযায়ী তারা যে জবানবন্দী দেয় তা নিম্নরূপঃ- “আমরা খ্রীষ্টান। দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদেরকে মুসেল শহরের ইহুদীরা সুদক্ষ কর্মী দ্বারা প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রচুর অর্থসহকারে এখানে পাঠিয়েছে। সুদূর ইউরোপ থেকে আমাদেরকে এ উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে যে, মদীনায় অবস্থান করে যে কোন কৌশলেই হোক বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার জিসম মুবারক বের করে ইউরোপীয় ইহুদীদের হাতে হস্তান্তর করতে হবে। তাই আমরা রওজা মুবারকের নিকটে অবস্থান করি। সুযোগ বুঝে সূড়ঙ্গ খনন করি। আর রাতে জান্নাতুল বাকী জিয়ারতের নামে সেখানে খননকৃত মাটি রেখে আসি। দীর্ঘ তিন বৎসর যাবৎ আমরা দু’জন এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নেরত আছি। যে রাত্রিতে আমরা রওজা মুবারকের নিকট পৌঁছে গেলাম আর আমাদের পরিকল্পনা যে, এক সপ্তাহের মধ্যে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার জিসম মুবারক বের করে নিব। ঠিক এমনি সময় অনুভব করলাম যে, আকাশ পাতাল বিদীর্ণ হচ্ছে। ভূমিকম্প আরম্ভ হয়ে গেছে। সূড়ঙ্গের ভিতরেই যেন আমরা। সমাধিস্থ হয়ে পড়বো। এ ধরণের লক্ষণ দেখে ভীত সস্ত্রস্ত অবস্থায় কাজ বন্ধ রেখেছি। সেদিন সকালেই ন্যায়পরায়ণ বাদশাহর আগমন এবং তিনি ১৬ হাজার সৈন্য দ্বারা মদীনার চতুর্দিকে এমনভাবে বেষ্টন করেছেন যে আমাদের এখান থেকে গোপনে পালাবার কোন পথ ছিল না।”
অতঃপর সে দুজন আসামিকে মৃত্যদন্ড দেযা হয় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিস্বরূপ তাদের মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
অতঃপর বাদশাহ্ বিপুল পরিমাণে অর্থ ব্যয় করে কয়েক প্রকারের ধাতু গলিয়ে রওজা মুবারকের চতুস্পার্শে মোটা মোটা রডসহ কয়েক হাজার মণ সীসা গলিয়ে ১৩০ হাত পর্যন্ত নিম্নভাগে কুপ খনন করে অত্যধিক মজবুত প্রাচীর নির্মান করে দেন।
বর্তমান অবস্থা এই যে, ১৩০ হাত পর্যন্ত নিম্নভাগে যদি কেউ বিন্দুমাত্র কোন প্রকার আঘাত হানে বা ক্ষতি করার চেষ্টা করে, সংগে সংগে তার উপরিভাগে ধরা পড়বে। বাদশাহ নূরুদ্দীন দীর্ঘ ৬ মাস পর্যন্ত মদীনা শরীফে অবস্থান করে নিজ দায়িত্বে অসাধ্য সাধন করে আল্লাহ্ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার রওজা মুবারকের রক্ষণা-বেক্ষণের এই মহান কাজ সম্পাদন করেন। অতঃপর তিনি সপ্তাহকাল ব্যাপী দরবারে ইলাহীতে নিজের অক্ষমতার কথা পেশ করে অশ্রুসিক্ত নয়নে শুকরানা আদায় করে প্রত্যাবর্তন করেন। (সুবহানাল্লাহ)

0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন